ভোক্তা আচরণ কাকে বলে? ভোক্তা আচরণের বৈশিষ্ট্য

ভোক্তা আচরণ কাকে বলে? Definition of Consumer Behavior

যেসব ব্যক্তি পণ্যসামগ্রী বা সেবাকর্ম ভোগ বা ব্যবহার করে তাদের সাধারণত ভোক্তা বলা হয়। ভোক্তাদের পণ্যসামগ্রী ক্রয়কালে তাদের সাধারণ কতিপয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। মূলত পণ্যসামগ্রী ক্রয়কালে ভোক্তার মধ্যে আচরণের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাই ভোক্তার আচরণ। পণ্যসামগ্রী বা সেবাকর্ম ক্রয়ের সময় একজন ভোক্তা যেসব কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে সেসব কাজের সাথে সম্পর্কিত সব আচরণকে ভোক্তার আচরণ বলে।

ভোক্তার আচরণ সম্পর্কে Philip Kotler এবং Gary Armstrong বলেন, “ভোক্তার আচরণ বলতে চূড়ান্ত ভোক্তাদের ক্রয় আচরণকে বোঝায় যারা নিজস্ব ও পারিবারিক প্রয়োজন পণ্য ও সেবা ক্রয় করে।”

Skinner বলেন, “ভোক্তা আচরণ হলো যেসব লোক ব্যক্তিগত ভোগের জন্য পণ্য ও সেবা ক্রয় করে তাদের কার্যাবলি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া।”

ভোক্তার আচরণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন Loudon এবং Britta। তাদের মতে, “পণ্য বা সেবা ক্রয় বা ব্যবহার করার সাথে সম্পর্কযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও শারীরিক কার্যাবলিকে সামগ্রিকভাবে ভোক্তার আচরণ বলে।”

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, শুধু ভোগের উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয়ের সাথে সম্পর্কিত আচরণই ভোক্তার আচরণ নয় বরং কোনো ব্যক্তি সেবা গ্রহণকালে যে আচরণ করে তাও ভোক্তার আচরণের আওতাভুক্ত।

ভোক্তা আচরণের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Consumer Behavior

যেসব ব্যক্তি পণ্য সামগ্রী বা সেবাকর্ম ভোগ বা ব্যবহার করে তাদের সাধারণত ভোক্তা বলা হয়। ভোক্তার আচরণ হলো পণ্য ক্রয়ে ভোক্তার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। ভোক্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পণ্য ক্রয় বা ব্যবহারের সাথে যেসব আচরণ শারীরিক ও মানসিক কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকে তাই ভোক্তা আচরণ। বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উদ্দীপক দ্বারা ভোক্তা আচরণ প্রভাবিত হয়। নিম্নে ভোক্তা আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:

১. প্রেষণাগত আচরণ (Motivational behavior): একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনেকগুলো প্রয়োজন অনুভব করে। এর মধ্যে কতগুলো আছে জৈবিক আর কতগুলো আছে মনোগত। জৈবিক প্রয়োজনের মধ্যে আছে ক্ষুধা আর মনোগত প্রয়োজনের মধ্যে স্বীকৃত, মর্যাদা, ভালোবাসার চাহিদা ইত্যাদি। প্রেষণা এমন এক শক্তি যা মানুষকে পরিচালনা করে এবং মানুষের মধ্যে কর্মসম্পাদনের শক্তি জোগায়।

২. শিক্ষালব্ধ আচরণ (Learned behavior): শিক্ষণ ভোক্তা আচরণের একটি মৌলিক উপাদান, যা ক্রয় আচরণকে প্রভাবিত করে। মানুষের অধিকাংশ আচরণই শিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত হয়। অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে ভোক্তার আচরণে যে পরিবর্তন হয় তাকে শিক্ষণ বলে।

৩. মানসিক প্রক্রিয়া (Mental process): কোন পণ্য ক্রয়ের আগে একজন ভোক্তা প্রথমেই প্রয়োজন শনাক্ত করে। প্রয়োজন শনাক্তের পর ক্রেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন- সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিও থেকে পণ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। বাজারের প্রতিযোগী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে তুলনা করে মান নির্ধারণ করার পরে ক্রয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এসব কাজে ভোক্তার মানসিক প্রক্রিয়া জড়িত। পণ্য ব্যবহারের পর সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির ভিত্তিতে ভোক্তা পরবর্তীতে ঐ ব্র্যান্ডটি আবার ক্রয়ের বা না ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।

৪. ক্রয় সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া (Buying decision process): ভোক্তা আচরণের ক্ষেত্রে ক্রয় সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে একজন ভোক্তা ভিন্ন ধাপে অগ্রসর হয়ে ক্রয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

৫. কতকগুলো কর্মের সমষ্টি (Combination of various activities): পণ্য ক্রয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। এই প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। যেমন- প্রয়োজন শনাক্তকরণ, তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন এবং সবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একটি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। তাই বলা হয় ভোক্তার আচরণ কতকগুলো কর্মের সমষ্টি।

৬. উদ্দীপকের প্রভাব (Influence of stimuli): বাজারজাতকরণ ও অন্যান্য উদ্দীপক দ্বারা ভোক্তার আচরণ প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে স্থিতিস্থাপক চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে উদ্দীপক বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যেমন: ১টি সনি টিভির যদি ৫০% মূল্য হ্রাস করা হয় তবে ক্রেতারা অধিক পরিমাণে তা ক্রয় করবে। এক্ষেত্রে মূল্য হ্রাস বাজারজাতকরণ উদ্দীপক হিসেবে ভোক্তাকে ক্রয় সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করছে।

৭. সময় জটিলতাভেদে ভোক্তার আচরণ ভিন্ন হয় (Consumer behavior differs in timing and complexity): সময়ের দাবি ও জটিলতাভেদে ভোক্তার আচরণে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন: অফিসে যাওয়ার সময় গাড়ি পাওয়ার জন্য ভোক্তার আচরণ অন্য সময়ের আচরণ অপেক্ষা ভিন্ন হয়। আবার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্য ক্রয়ের চেয়ে দামি ও জটিল প্রকৃতির পণ্য ক্রয়ের সময় আচরণ ভিন্ন হয়।

৮. ভোক্তা ভেদে আচরণ বিভিন্ন (Varied behavior among consumers): বাজারে ভিন্ন ধরনের ভোক্তা বিদ্যমান। যেমন: Cats eye-এর শার্ট দাম কমিয়ে ৬০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা করা হলো। কেউ কেউ হয়তো উদ্বুদ্ধ হয়ে একসাথে কয়েকটি শার্ট কিনে রাখবে। আবার কেউ কেউ এ মূল্য হ্রাসে শার্ট কেনার কোনো আগ্রহই হয়তো দেখাবে না।

৯. অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উপাদানের প্রভাব (Influence of internal and external factor): অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অনেকগুলো উপাদান ভোক্তার ক্রয় আচরণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এদের মধ্যে প্রত্যক্ষণ, শিক্ষণ, বিশ্বাস প্রভৃতি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ উপাদান আর সংস্কৃতি, সামাজিক শ্রেণী, রেফারেন্স গ্রুপ প্রভৃতি বাহ্যিক উপাদান।

১০. উদ্দেশ্যমুখী আচরণ (Purposive behavior): উদ্দেশ্যমুখী আচরণ বলতে বোঝায় ভোক্তার পণ্য ক্রয় বা ভোগের দিকে লক্ষ্য রেখে ধাবিত হওয়া। অর্থাৎ ভোক্তা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই অগ্রসর হয়।

একজন বাজারজাতকারী বাজারে সফলভাবে টিকে থাকতে চাইলে ভোক্তা আচরণের উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করে বাজারজাতকরণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সফলভাবে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।