জাতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য (Definition and Characteristic of caste system)

শ্রেণিব্যবস্থা ছাড়া জাতিব্যবস্থা হল ভারতীয় সমাজের একটি সুপ্রাচীন বৈশিষ্ট্য। ইংরেজি Caste শব্দটির অর্থ হলো জন্ম বা বংশানুক্রমিক অর্থাৎ জাতি জন্মভিত্তিক।

অধ্যাপক মজুমদার ও মদনের মতে, জাতি বলতে এক বদ্ধ গোষ্ঠীকে বোঝায়। বস্তুতপক্ষে জাতি হল এক আন্তঃবৈবাহিক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যদের সামাজিক ক্ষেত্রে কতকগুলি বিধিনিষেধ বা আচার-আচরণ মেনে চলেতে হয়। এরা চিরাচরিত ও অভিন্ন বৃত্তি অনুযায়ী এবং উৎপত্তিসূত্রে এক ও সমজাতীয় স্বরূপ। সমাজতাত্ত্বিক কুলীর মতে, একটি জনগোষ্ঠী জন্মের ভিত্তিতে কিছু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং চিরাচরিত বৃত্তি অনুসরণ করলে, তাকে জাতি বলে।

সংক্ষেপে জাতি হল এক বংশানুক্রমিক গোষ্ঠী যার একটি চিরাচরিত পেশা রয়েছে এবং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট আচরণ ও বিধিনিষেধ রয়েছে। 

জাতিব্যবস্থার বৃত্তি অনযায়ী ভারতীয় সমাজের জনগোষ্ঠীকে প্রধান চারভাগে বিভক্ত করা হয় – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র।

সমাজতাত্ত্বিক ঘুরে মন্তব্য করেন আর্যদের আগমনের পর উপজাতিদের সঙ্গে পার্থক্য রক্ষার জন্য জাতির উদ্ভব হয়। এক শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে, শ্রেণি যখন পেশা বা  বৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং বংশধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়, তখন জাতির উদ্ভব হয়। লেসফিল্ডের মতে, আর্যরা আসার পূর্বে ভারতে প্রাক দ্রাবিড়ীয় অধিবাসীদের মধ্যে জনগোষ্ঠীগুলি নির্দিষ্ট পেশার ভিত্তিতে বিভক্ত ছিল। পরবর্তীকালে আর্য আগমন ও হিন্দু শাস্ত্রের চার বর্ণের ( ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) ভিত্তিতে সৃষ্ট বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য জন্ম-ভিত্তিক হওয়ার ফলে জাতিব্যবস্থার উদ্ভব হয়।

বর্ণ ও জাতির মধ্যে মূল পার্থক্য হল যে, বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা (ব্রাহ্মণ, ক্ষৈত্র, বৈশ্য ও শূদ্র) (সত্তঃ রজ, তম) গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে গঠিত ছিল কিন্তু জাতিব্যবস্থা জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে অবস্থান পরিবর্তন করা যায় না এবং বিবাহাদি নিজ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

যাই হোক, প্রাচীন ভারতে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার উচ্চবর্ণ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাধান্য রক্ষার জন্য উচ্চবর্ণের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও সেবা শূদ্রদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। চতুবর্ণের উৎপত্তি সম্পর্কে ঋক্ বেদে বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের আবির্ভাব হয়েছে। জ্ঞান অর্জন হলো ব্রাহ্মণের প্রধান কাজ। ক্ষত্রিয় বাহু থেকে নির্গত হয়েছে, যুদ্ধ ও শাসন হল ক্ষত্রিয়ের প্রধান দায়িত্ব। ব্রহ্মার উরু থেকে আবির্ভাব বৈশ্যের প্রধান পেশা হল বাণিজ্য। ব্রহ্মার পদযুগল হতে সৃষ্ট শূদ্রের প্রধান কতর্ব্য হল উপরোক্ত তিন বর্ণের সেবা করা।

সমাজ বিভাজনের ক্ষেত্রে শ্রেণী হল মুক্ত ব্যবস্থা এবং জাতি হল বদ্ধ ব্যবস্থা। এই দুটি ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জ্য লক্ষ করা যায়। সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে শ্রেণী ও জাতির মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য লক্ষণীয়।

প্রথমত, জন্মসূত্র অথবা কুলগত বিচার হল জাতিভেদে প্রথার ভিত্তি। তাই জাতিভেদ প্রথা বংশানুক্রমিক এবং জাতি হল একটি বদ্ধ গোষ্ঠী। একটি জাতির মধ্যে অন্য জাতির মানুষের প্রবেশ বা অন্তর্ভূক্তি অসম্ভব। অন্যদিকে শ্রেণীভেদ হল সামাজিক স্তরবিন্যাসের আধুনিক রূপ। জীবনের সুযোগসুবিধা, নতুন নতুন সম্ভাবনার তারতম্য বা সামাজিক প্রতিষ্ঠার বৈষম্য হল শ্রেণীভেদের ভিত্তি। সামাজিক বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিভেদ সূচিত, কিন্তু অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণীভেদ সূচিত হয়।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক সচলতা শ্রেণীবিন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। জাতিবিন্যাসের ক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে আরোহণ-অবরোহণের সুযোগ আছে। জাতিভেদ প্রথায় এই সুযোগ নেই। তাই আধুনিক সমাজের শ্রেণীবিন্যাস হল মুক্ত সমাজের প্রতীক।

তৃতীয়ত, শ্রেণীবিন্যাসের ক্ষেত্রে পদমর্যাদার প্রশ্নটি পূর্বনির্ধারিত বা অপরিবর্তনীয় নয় – পরিবর্তনযোগ্য। কিন্তু জাতিবিন্যাসের ক্ষেত্রে পদমর্যাদা জন্মসূত্রে নির্দিষ্টের পরিবর্তন ঘটে না। অর্থাৎ সামাজিক শ্রেণীর মর্যাদা অর্জিত এবং জাতির মর্যাদা আরোপিত।

চতুর্থত, অন্তর্বিবাহ জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সামাজিক শ্রেণীর এই বৈশিষ্ট্য নেই। জাতিব্যবস্থায় বিবাহের ব্যাপারে পাত্রপাত্রীকে সমজাতিভুক্ত হতে হয়। কিন্তু শ্রেণীর ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর ব্যক্তির অপর শ্রেণীর বিবাহের পথে কোনো বাধা নেই। সমপাঙক্তেয়তা হল জাতি ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও দূরত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে খাদ্য গ্রহণ, জল চল-অচল ইত্যাদি সম্পর্কে বিধিনিষেধ রয়েছে। নিম্ন জাতির সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে।

পঞ্চমত, সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে যে শ্রেণীর চেতনা এবং শ্রেণী – সংহতির কথা বলা হয়, জাতিভেদ ব্যবস্থায় তা দেখা যায় না।

ষষ্ঠত, জাতি হল বৃত্তিভিত্তিক। একটি জাতিরর চিরাচরিত পেশা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ব্রাহ্মণের পেশা হল পূজা-অর্চনার, মুচির পেশা হল জুতো তৈরি, নাপিতের পেশা হল ক্ষৌর কর্ম। প্রতিটি জাতির নিজস্ব উপসংস্কৃতি ও রীতিনীতি রয়েছে।

পরিশেষে, জাতিব্যবস্থার ক্ষেত্রে জাতিগত পদবি উল্লেখযোগ্য।

Leave a Comment