টিস্যু কালচার কাকে বলে? টিস্যুকালচার প্রযুক্তির ধাপসমূহ এবং টিস্যু কালচারের ব্যবহার

টিস্যু কালচার কাকে বলে?

সাধারণত এক বা একাধিক ধরণের এক গুচ্ছ কোষসমষ্টিকে টিস্যু (Tissue) বা কলা বলা হয়। একটি টিস্যুকে জীবানুমুক্ত পুষ্টিবর্ধক কোন মিডিয়ামে (Nutrient medium) বর্ধিতকরণ প্রক্রিয়াই হলো টিস্যু কালচার।

টিস্যু কালচার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের একটি অপেক্ষাকৃত নতুন শাখা। উদ্ভিদ টিস্যু কালচারে উদ্ভিদের কোন বিচ্ছিন্ন অংশ বা অঙ্গবিশেষ যেমন পরাগরেণু, শীর্ষ বা পার্শ্বমুকুল, পর্ব, মূলাংশ ইত্যাদিকে কোনো নির্দিষ্ট পুষ্টিবর্ধক মিডিয়ামে জীবানুমুক্ত অবস্থায় কালচার করা হয়।

মিডিয়ামসমূহে পুষ্টি ও বর্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপাদান সরবরাহ করা হয়। 

টিস্যু কালচারের উদ্দেশ্যে উদ্ভিদের যে অংশ পৃথক করে নিয়ে ব্যবহার করা হয় তাকে ‘এক্সপ্ল্যান্ট (Explant) বলে।

টিস্যুকালচার প্রযুক্তির ধাপসমূহ

১) মাতৃউদ্ভিদ নির্বাচনঃ উন্নত গুণসম্পন্ন, স্বাস্থ্যবান ও রোগমুক্ত উদ্ভিদকে এক্সপ্ল্যান্টের জন্য নির্বাচন করা হয়।

২) আবাদ মাধ্যম তৈরিঃ উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পুষ্টি, ভিটামিন, ফাইটোহরমোন, সুক্রোজ এবং প্রায় কঠিন মাধ্যম (Semi-soid medium) তৈরির জন্য জমাট বাঁধার উপাদান, যেমন অ্যাগার (Agar) প্রভৃতি সঠিক মাত্রায় মিশিয়ে আবাদ মাধ্যম তৈরি করা হয়।

 ৩) জীবাণুমুক্ত আবাদ প্রতিষ্ঠাঃ আবাদ মাধ্যমকে কাচের পাত্রে (টেস্টটিউব, কনিক্যাল ফ্লাস্ক) নিয়ে তুলা বা প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে অটোক্লেভ (Autoclave) যন্ত্রে ১২১° সে. রেখে তাপমাত্রায়, ১৫ lb/sq.inch চাপে ২০মি. রেখে জীবাণুমুক্ত করা হয়। জীবাণুমুক্ত তরল আবাদকে ঠাণ্ডা ও জমাট বাঁধার পর এক্সপ্লান্টগুলোকে এর মধ্যে স্থাপন করা (Inoculate) হয়। তারপর কাঁচের পাত্রের মুখ পুনুরায় বন্ধ করে নির্দিষ্ট আলো ও তাপমাত্রা (২৫+২° সে.) সম্পন্ন নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বর্ধনের জন্য রাখা হয়। এই পর্যায়ে আবাদে স্থাপিত টিস্যু বারবার বিভাজনের মাধ্যমে সরাসরি অনুচারা (Plantlets) তৈরি হয় বা ক্যালাস (Callus) বা অবয়বহীন টিস্যুমণ্ডে পরিণত হয়। এই টিস্যুমণ্ড হতে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে একাধিক অনুচারা (Plantlets) উৎপন্ন হয়।

৪) মূল উৎপাদক মাধ্যমে স্থানান্তরঃ এ সমস্ত উৎপাদিত চারাগাছে যদি মূল উৎপন্ন না হয় তবে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা লাভের পর বিটপগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয় এবং তাদেরকে পুনরায় মূল উৎপাদনকারী আবাদ মাধ্যমে স্থাপন করা হয়।

৫) প্রাকৃতিক পরিবেশে তথা মাঠপর্যায়ের স্থানান্তরঃ মূলযুক্ত চারাগুলোকে পানিতে ধুয়ে অ্যাগারমুক্ত অবস্থায় ল্যাবরেটরিতে মাটিভরা ছোট ছোট পাত্রে স্থানান্তর করা যায়। পাত্রে লাগানো চারাগুলো কক্ষের বাইরে রেখে মাঝে মাঝে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। পূর্ণাঙ্গ চারাগুলো সজীব ও সবল হয়ে উঠলে সেগুলোকে এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে মাটিতে লাগানো হয়।

টিস্যু কালচারের ব্যবহার

টিস্যুকালচার প্রযুক্তির কৌশলকে কাজে লাগিয়ে আজকাল উদ্ভিদ প্রজননের ক্ষেত্রে এবং উন্নত জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গেছে এবং এ ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে উদ্ভিদাংশ থেকে কম সময়ের মধ্যে একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অসংখ্য চারা সৃষ্টি করা যায়।

সহজেই রোগমুক্ত, বিশেষ করে ভাইরাস মুক্ত চারা উৎপাদন করা যায়। ঋতুভিত্তিক চারা উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। স্বল্পসময়ে কম জায়গার মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক চারা উৎপাদনের সুবিধা থাকায় চারা মজুদের সমস্যা এড়ানো যায়। যে সব উদ্ভিদ বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে না সেগুলোর চারাপ্রাপ্তি ও স্বল্পব্যয়ে প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত।

যেসব ভ্রূণে শস্যকলা থাকে না সে সব ভ্রূণ কালচার করে সরাসরি উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায়। যে সকল উদ্ভিদে যৌনজনন অনুপস্থিত অথবা প্রাকৃতিকভাবে জননের হার কম তাদের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যায়।

নতুন প্রকৃতির উদ্ভিদ উদ্ভাবনে টিস্যুকালচার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফরাসি বিজ্ঞানী George Morel (১৯৬৪) প্রমাণ করে দেখান যে, সিম্বিডিয়াম (Cymbidium) নামক অর্কিড প্রজাতির একটি মেরিস্টেম হতে এক বছরে ৪০ হাজার চারা পাওয়া সম্ভব।

উল্লেখ্য যে, সাধারণ নিয়মে একটি সিম্বিডিয়াম উদ্ভিদ হতে বছরে অল্প কয়েকটি চারা উৎপন্ন হয়। থাইল্যাণ্ড টিস্যুকালচার পদ্ধতির মাধ্যমে একবছরে ৫০ মিলিয়ন অনুচারা উৎপন্ন করে যার অধিকাংশই অর্কিড। এই ফুল রপ্তানি করে থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া প্রভৃতি দেশ প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। ১৯৫২ সালে মার্টিন নামক বিজ্ঞানি মেরিস্টেম কালচারের মাধ্যমে রোগমুক্ত ডালিয়া ও আলুগাছ লাভ করেন।

বর্তমানে মেরিস্টেম কালচারের মাধ্যমে কোনো ভাইরাস রোগাক্রান্ত ফুল ও ফলগাছকে যেমন – আলুর টিউবারকে রোগমুক্ত করা টিস্যুকালচারের একটি নিয়মিত কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় oil palm – এ বংশবৃদ্ধি টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হয়। 

টিস্যুকালচারের মাধ্যমে চন্দ্রমল্লিকার একটি অঙ্গজ টুকরা হতে বছরে ৮৮ কোটি চারা গাছ পাওয়া সম্ভব। যুঁই (Jasminium) সাস্পেনসান হতে সুগন্ধি আতর এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। উড়োজাহাজ, রকেট প্রভৃতি ভারী ইঞ্জিন চালানোর জন্য এক রকমের তিমি মাছের (Sperm whale) তেলের প্রয়োজন হয়। এই তিমি মাছ ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র জোজোবা (jojoba) নামক গাছ হতে নিষ্কাশিত তেল বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু এই গাছ এক বিশেষ মরুভূমির পরিবেশ ছাড়া যেমন – (Arizona, California) জন্মায় না এবং এদের বংশবৃদ্ধিও অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। টিস্যুকালচারের মাধ্যমে এই গাছের দ্রুত বংশবৃদ্ধি করাই কেবল সম্ভব হয় নি, একে ভারতবর্ষের জলবায়ু উপযোগী করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশে টিস্যুকালচারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। যেমন – বিভিন্ন প্রকার দেশি ও বিদেশি অর্কিডের চারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।

রোগ প্রতিরোধী এবং অধিক উৎপাদনশীল কলার চারা, বেলের চারা, কাঁঠালের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস, লিলি, কার্নেশান প্রভৃতি ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। কদম, জারুল, ইপিল ইপিল, বক ফুল, সেগুন, নিম প্রভৃতি কাঠ উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। বিভিন্ন ডালজাতীয় শস্য, বাদাম ও পাট এর চারা উৎপাদন করা হয়েছে। টিস্যুকালচার প্রয়োগ করে আলুর রোগমুক্ত চারা এবং বীজ মাইক্রোটিউবার উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।