বিশেষ শিক্ষা কাকে বলে? বিশেষ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য, বিশেষ শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলি কি কি? বিশেষ শিক্ষার গুরুত্ব ও বিশেষ শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পার্থক্য আলোচনা করা হয়েছে।
বিশেষ শিক্ষা কাকে বলে?
বিশেষ শিক্ষা বলতে বোঝায় ,বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করে তাদের বিশেষ শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা। ব্যতিক্রমধর্মী শিশুদের চাহিদা মেটানোর জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন তাকেই বিশেষ শিক্ষা বলে।
বিশেষ শিক্ষা এই নামকরণ থেকেই স্পষ্ট হয় যে, সাধারণ প্রথাগত শিক্ষার তুলনায় অধিকতর কিছু বৈশিষ্ট্য এই শিক্ষাব্যবস্থায় আছে। কাদের জন্য প্রয়োজন এই বিশেষ শিক্ষ? যে সমম্ত শিক্ষার্থীরা ব্যতিক্রমী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন তাদের শিক্ষাদানের ও তাদের শিক্ষালাভের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যই বিশেষ শিক্ষার উদ্যোগ। এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিবর্গ সংখ্যায় নেহাত কম নয়। ২০১১ সালের জনগণনা থেকে জানা যায় যে ভারতে ১২১ কোটি জনসংখ্যার ২.৬৮ কোটি ব্যক্তি কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। এই ব্যক্তিবর্গ মোট জনসংখ্যার ২.২১ শতাংশ।
এই বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য বিশেষ শিক্ষার উদ্ভাবন ও প্রচলন। স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের চেয়ে যারা কোনো কারণে পৃথক (হয় অগ্রগামী বা উন্নত অথবা পশ্চাদগামী বা অনুন্নত) তাদের শিক্ষাদানের প্রয়োজনে বিশেষ শিক্ষার অবতারণা। বিশেষ শিক্ষা কোনো ভিন্নধর্মী ধারা নয় বরং মূল শিক্ষাধারার একটি সমৃদ্ধ অংশ।
বিশেষ শিক্ষার ক্ষেত্র যেমন বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনশীল ও প্রতিভাবান শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য বিস্তৃত; তেমনই দৈহিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে অনগ্রসর শিশুদের শিক্ষা এই বিশেষ শিক্ষার পরিধির অন্তর্গত।
Hallahan and Kauffman-এর মতে, “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর ব্যতিক্রমী চাহিদাগুলি পূরণের জন্য বিশেষ নির্দেশদান পদ্ধতি অনুসরণ করাই হল বিশেষ শিক্ষা। যা সফল করার জন্য বিশেষ শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষা পদ্ধতি এবং সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন।”
অপর একটি সংজ্ঞা Kirk Gallagher (1986) – বলেছেন, “…The help that the schools devise for children who differ significantly from the norm is called special education” এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিদ্যালয়গুলি বিশেষ শিশুদের সাহায্যার্থে বিশেষ শিক্ষা প্রদান করে।
সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বিশেষ শিক্ষা হলো কতগুলি শিক্ষাগত ও সামাজিক পরিসেবার সংকলন যা সাধারণ বিদ্যালয়ে ও সমতুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ৩ – ২১ বছর বয়স শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রচলন করা হয়।
বিশেষ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের চাহিদাগুলি পূর্ণ করার লক্ষ্যে বিশেষ শিক্ষার পরিকল্পনা করা হয়, যার বৈশিষ্ট্যগুলি হলো-
১) বিশেষ চাহিদা চিহ্নিতকরণঃ অক্ষমতার ক্ষেত্র ও মাত্রা অনুযায়ী এই শিক্ষার্থীদের বিশেষ চাহিদাগুলি ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই বিশেষ শিক্ষার প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম কাজ হল সেই বিশেষ চাহিদাগুলি ক্ষেত্র ও মাত্রা অনুযায়ী এই শিক্ষার্থীদের বিশেষ চাহিদাগুলি ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই বিশেষ শিক্ষার প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম কাজ হলো সেই বিশেষ চাহিদাগুলি চিহ্নিত করা। প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি অবগত থাকলে উপযুক্ত পাঠ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়। প্রথম পদক্ষেপ বিশেষ চাহিদার ক্ষেত্র শনাক্ত করা। কেবলমাত্র বিশেষ চাহিদার ক্ষেত্রই নয় চাহিদার মাত্রাও নির্ণয় করতে হবে। তাই বিশেষ চাহিদা চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে চাহিদার ক্ষেত্র ও মাত্রা নির্ণয় করা একান্ত প্রয়োজনীয়।
২) বিষয়বস্তু নির্বাচনঃ বিশেষ শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উপযুক্ত শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু নির্বাচন করা। চাহিদা গুলি ভিন্ন ভিন্ন হবার কারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমে বিভিন্ন বিষয় সংযোজিত হয়। শিক্ষার্থীরা সেই বিশেষ বিষয়সমৃদ্ধ পাঠক্রম অনুসরণ করে শিখন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তাই চাহিদাভিত্তিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে পাঠক্রমকে গ্রন্থনা করা বিশেষ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য।
৩) শিখন পদ্ধতি নির্বাচনঃ বিশেষ পাঠক্রম উপস্থাপনায় পদ্ধতিটি নির্বাচন করার পরেও বিশেষ শিক্ষার সার্থকতা নির্ভর করে। কী কী শিখন পদ্ধতি বা নির্দেশদান প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে বিশেষ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো যাবে তা যত্ন ও বিবেচনা সহকারে স্থির করতে হয় এবং প্রয়োগ করতে হয়।
৪) শিক্ষক প্রশিক্ষণঃ বিশেষ শিক্ষার অন্যতম ধারক ও বাহক হলেন শিক্ষক। তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশেষ শিক্ষার একটি বৈশিষ্ট্য। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য থাকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করার উপযোগী শিক্ষক সরবরাহ করা।
৫) প্রতিষ্ঠাকরণ বা বৃত্তি নির্বাচনঃ বিশেষ শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হলো এই শিক্ষার্থীদের স্বনির্ভর করে তোলা এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা। তাই বিশেষ শিক্ষায় চাহিদা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি বৃদ্ধি নির্বাচনের কাজটিও করা হয়। বিশেষ শিক্ষা পরিকল্পনা তখনই বাস্তবমুখী ও সফল হয় যখন শিক্ষার্থীরা নিজের জীবনে প্রতিষ্টিত হতে পারে।
৬) মানবসম্পদের পূর্ণঙ্গ ব্যবহারঃ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় সমগ্র মানুষের কত বৃহৎ অংশ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। আমাদের দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের মধ্যে ৭৫% গ্রামাঞ্চলে ও ২৫% শহরাঞ্চলে বসবাসকারী। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করার জন্য শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া একান্ত জরুরি। বিশেষ শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ জনগণকে শিক্ষাদান করে সমাজের মূল্যবান মানব সম্পদে রূপান্তর করা।
বিশেষ শিক্ষার উদ্দেশ্য গুলি কি কি?
বিশেষ শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল প্রতিটি শিক্ষার্থীকে, তাদের শারীরিক, মানসিক বা শিক্ষণগত চ্যালেঞ্জ যাই হোক না কেন, সর্বোচ্চ সম্ভাব্য শিক্ষাগত সাফল্য অর্জন করতে সহায়তা করা। এটি শুধুমাত্র শিক্ষাগত জ্ঞান অর্জনের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা, স্বাবলম্বন এবং সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা।
বিশেষ শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য গুলি হল:
১) সর্বোচ্চ সম্ভাব্য শিক্ষাগত সাফল্য: প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তাদের নিজস্ব গতিতে এবং শক্তির মাত্রায় শিখতে সহায়তা করা।
২) স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বন: শিক্ষার্থীদেরকে দৈনন্দিন জীবনে স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করা।
৩) সামাজিক দক্ষতা বিকাশ: অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে, সহযোগিতা করতে এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা।
৪) আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস গড়ে তুলতে এবং নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা।
৫) সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ: সমাজের একজন সক্রিয় এবং অবদানকারী সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করা।
বিশেষ শিক্ষার গুরুত্ব
বিশেষ শিক্ষার গুরুত্ব নিম্নরূপ-
১) ব্যক্তিগত বিকাশ: বিশেষ শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জন্য ব্যক্তিগত শিক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করে, যা তাদেরকে তাদের নিজস্ব গতিতে শিখতে সাহায্য করে। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং তাদের স্বাধীনতা বাড়ায়।
২) সামাজিক দক্ষতা বিকাশ: বিশেষ শিক্ষা শিশুদেরকে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে সামঞ্জস্য রাখতে শেখায়। এটি তাদেরকে সমাজের সক্রিয় সদস্য হতে সাহায্য করে।
৩) শিক্ষাগত অর্জন: বিশেষ শিক্ষা শিশুদেরকে তাদের শিক্ষাগত লক্ষ্য অর্জন করতে সাহায্য করে। এটি তাদেরকে ভবিষ্যতে স্বাধীন এবং সফল জীবন যাপন করার জন্য প্রস্তুত করে।
৪) সমাজের জন্য উপকার: বিশেষ শিক্ষা একটি সামাজিক দায়িত্ব। এটি একটি সুস্থ এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে অবদান রাখে।
বিশেষ শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পার্থক্য
বিশেষ শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পার্থক্য নিম্নরূপ-
বৈশিষ্ট্য | বিশেষ শিক্ষা | অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা |
---|---|---|
পরিবেশ | পৃথক শ্রেণীকক্ষ | সাধারণ শ্রেণীকক্ষ |
ফোকাস | অসুবিধা | শক্তি |
উদ্দেশ্য | সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠা | সমতা আনা |
শিক্ষক | বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত | সকল শিক্ষার্থীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম |
Frequently Asked Questions
বিশেষ শিক্ষা কী?
বিশেষ শিক্ষা হল এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শারীরিক, মানসিক বা শিক্ষাগতভাবে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকা শিশুদের তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনের জন্য বিশেষ সহায়তা ও পরিষেবা প্রদান করা হয়।
বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন কেন?
সকল শিশুই একই নয়। অনেক শিশুর শেখার ধরণ, গতি ও পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। বিশেষ শিক্ষা এই ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রতিটি শিশুকে তার নিজস্ব গতিতে শিখতে সাহায্য করে।
বিশেষ শিক্ষার লক্ষ্য কী?
বিশেষ শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল প্রতিবন্ধী শিশুদের যাতে তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে, সমাজে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারে সেজন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বিশেষ শিক্ষায় কে কে জড়িত থাকে?
বিশেষ শিক্ষায় শিশু, শিক্ষক, অভিভাবক, বিশেষ শিক্ষক, স্কুল কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পেশাদাররা জড়িত থাকেন।
বিশেষ শিক্ষার জন্য শিশুকে কীভাবে চিহ্নিত করা হয়?
শিশুর শিক্ষক, অভিভাবক বা অন্য কোনো ব্যক্তি যদি শিশুর কোনো বিশেষ চাহিদা লক্ষ্য করেন, তাহলে তিনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিশুর মূল্যায়ন করবে এবং তার জন্য উপযুক্ত পরিষেবা নির্ধারণ করবে।
বিশেষ শিক্ষা কি শুধুমাত্র বিশেষ স্কুলেই দেওয়া হয়?
না, বিশেষ শিক্ষা সাধারণ স্কুলেও দেওয়া হতে পারে। অনেক স্কুলই বিশেষ শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে থাকে।
বিশেষ শিক্ষায় অভিভাবকের ভূমিকা কী?
অভিভাবকরা তাদের সন্তানের বিশেষ শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা শিক্ষকদের সাথে মিলে কাজ করেন, তাদের সন্তানের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের সন্তানকে বাড়িতেও সহায়তা করেন।