দর্শন কাকে বলে? দর্শনের উৎপত্তি কিভাবে

দর্শন কাকে বলে?

দর্শন, ইংরেজিতে ফিলোসফি (philosophy)।

জীবন ও জগত সম্পর্কিত মৌলিক সমস্যাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধান করাই হচ্ছে দর্শন।
দর্শন এমন একটি বিষয় যা জীবন জগতের সকল বিষয় তথা মৌলিক প্রশ্নসমূহের বিচার
বিশ্লেষণ মূল্যায়ন করে থাকে। তাই জ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যা দর্শনের আওতার
বাহিরে। দর্শন জ্ঞানের সকল শাখা, যেমন – পদার্থবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদ
বিজ্ঞান, সৌন্দর্য বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি। 

অর্থাৎ জগত জীবনের মৌলিক সমস্যাবলির একটি সুষ্ঠু, যুক্তসঙ্গত ও গুঢ় আলোচনার
প্রচেষ্টা চালায় দর্শন। 

দর্শনের উৎপত্তি কিভাবে

দর্শনের উৎপত্তি নিয়ে দার্শনিকদের মধ্য যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেমন, কেউ কেউ
মনে করেন কৌতুহল ও সংশয় থেকে দর্শনের উৎপত্তি, কেউ বা মনে করেন সত্যানুসন্ধান বা
জানার আকাক্সক্ষা থেকে দর্শনের উৎপত্তি।

আবার, কেউ মনে করেন ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকেই এর উৎপত্তি। অনেকে আবার আধ্যাত্মিক
প্রেরণা ও পিপাসাকেও দর্শন উৎপত্তির কারণ বলে মনে করেন। নিচে দর্শনের ঐতিহাসিক
ক্রমানুসরণে দর্শনের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদগুলো আলোচনা করা হলোঃ

সত্যানুন্ধান ও জ্ঞানস্পৃহা: দর্শনের লক্ষ্যই হলো সত্যানুসন্ধান করা। আর
দার্শনিকের কাজ সভ্য অনুসন্ধানে সমস্যা চিহ্নিত করা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে
যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান করা। আর এটা মানুষের জন্মগত স্পৃহাও বটে। প্রত্যেকটি
মানুষই কম বেশি সত্য জানতে চায়। সেদিক থেকে প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবেই দার্শনিক।
কেননা জীবন-জগত এবং সমস্যা নিয়ে সব মানুষই চিন্তা-ভাবনা করে।

বিষ্ময়, সংশয় ও কৌতূহল থেকে দর্শন: মানব শিশু যখন ভূমিষ্ট হয় তখন সে
ভূমিষ্ট হবার সাথে সাথেই চিৎকার করে কান্না করে। কারণ তার পরিবেশ ও
পারিপাশ্বির্কতা একেবারেই নতুন ও বৈচিত্র্যময়। আস্তে আস্তে সে যখন বড় হতে থাকে
বাড়তে থাকে তার কৌতূহল। অর্থাৎ কৌতূহল তার জন্মগত স্বভাব। এরপর সে কখনো বিষ্ময়,
কখনো বা সংশয় ভরে জানতে চায় তার জীবন ও জগতকে। আর মানুষের এ কৌতূহল ও বিস্ম§য়ই
জন্ম দেয় দর্শনের। নিত্য নতুন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করেই সে ক্ষান্ত হয় না আবিষ্কার
ও প্রতিষ্ঠা করে অনেক বড় কিছু। কবি নজরুলের ভাষায় বলা যায়, “বিশ্বজগত দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পরে”। বিশ্বজগতকে হাতের মুঠোয় পেতে মানুষের যে অদম্য বাসনা তা
জন্ম দেয় দর্শনের।

জীবনের নানাবিধ প্রয়োজন থেকেও দর্শন: অনেকে মনে করেন, জীবনের মৌলিক
প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করাই কেবল দর্শন নয়, জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনসহ আরো
অনেক প্রয়োজন থেকেও দার্শনিক আলোচনার উৎপত্তি ঘটে। প্রয়োগবাদী দার্শনিক মতবাদ
ব্যবহারিক প্রয়োগকে প্রাধান্য দিয়েই যাত্রা শুরু করে। উইলিয়াম জেমস, জন ডিউই,
এফ.সি শিলার প্রমুখ এ দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। জন ডিউই তার শিক্ষাতত্ত্বে উল্লেখ
করেন, যে শিক্ষা মানুষের কাজে লাগে না তা প্রকৃত শিক্ষা নয়। হাতে কলমে শিক্ষা ও
কারিগরি শিক্ষাকে তারা বেশি গুরুত্ব দেন। বিখ্যাত দার্শনিক কানিং হামও তাই মনে
করেন। মানুষের প্রয়োজনই মানুষকে জগত সম্বন্ধে তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
একইভাবে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে গড়ে উঠে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মতবাদ।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ পল সাত্র, কিয়াকেগার্ড প্রমুখ মনে করেন মানুষ এ
সমস্যা বহুল পৃথিবীতে অসহায় অবস্থায় জন্ম নেয় এবং বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে নানাবিধ
সমস্যার সম্মুখীন হয়। হাজারো পরিস্থিতির মধ্যে তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়
একান্ত নিজের জন্য। সেক্ষেত্রে তাকে তার নিজস্ব প্রয়োজন ও সমস্যার আলোকেই
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তার কোন প্রয়োজনকেই সে উপেক্ষা, অবহেলা বা অস্বীকার
করতে পারে না। কাজেই দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি মানুষের এ অস্তিত্বের উপরে গুরুত্বারোপ
করে জীবনের লক্ষ্য ও মূল্য নির্ধারণের চেষ্টা করে থাকে, যা মানুষের সমস্যা বা
প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দিয়েই অস্তিবাদাী দর্শন যাত্রা করে। এভাবে দেখা যায় জীবনের
নানা প্রয়োজন ও সমস্যা সমাধান কল্পেও দর্শনের উৎপত্তি হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়।
ভারতীয় চার্বাক দর্শনও মানুষের প্রয়োজনেই উদ্ভূত হয়।

মানুষের আধ্যাত্মিক পিপাসা থেকে দর্শন: মানুষ দৈহিক ও মানসিক উভয়টির
সমন্বয়ে গঠিত। সে যুগে যুগে মানসিক তৃপ্তি ও শান্তির অন্বেষায় কাজ করে।
আধ্যাত্মিক পিপাসা ও প্রয়োজন তারই একটি দিক যা মানুষের চিরন্তন সমস্যা। পরম
সত্তার পরিচয় পাওয়া, অনাবিল শান্তি, বিষণ্ন-শান্তি ইত্যাদি মরমীয়বাদের জন্ম দেয়।
ভারতীয় দার্শনিকদের মতে আধ্যাত্মিক প্রয়োজন পূরণেই দর্শনের উৎপত্তি। মহর্ষী কপিল
(সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক) বলেন, এ জগতে মানুষ আধ্যাত্মিক, আধিদেবিক ও আধিভৌতিক
এই ত্রিতাপে তাপিত। এই অশান্তি থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা থেকেই দর্শনের উৎপত্তি।