আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদের মূলনীতিগুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সাবেকি উদারনীতিবাদের বক্তব্য সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। গ্রিন, ব্র্যাডলি, বোসাঙকেটের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সংমিশ্রণে আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদ গড়ে ওঠে। সংশোধনমূলক বা আধুনিক উদারনীতিবাদের মূলনীতিগুলি হলো –

উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাঃ আধুনিক বা সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদে উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে –

  • জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ,
  • রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ এবং
  • শিক্ষার বিস্তার ও প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন।

পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতিঃ উদারনৈতিক মতবাদে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্যপ্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নাগরিকদের পৌর এবং রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে এখানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার, ধর্মের অধিকার, নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি।

সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনঃ উদারনৈতিক মতবাদ অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণভাবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যেকোনো সময় সরকারের বদল ঘটাতে সক্ষম।

আইনের অনুশাসন ও ন্যায়বিচারঃ আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং সাধারণ আইনের দ্বারা সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার উদারনৈতিক মতবাদে স্বীকৃত। আইনের অনুশাসনের মাধ্যমে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থাঃ উদারনৈতিক মতবাদে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার কথা বলা হয়। এই বিচারব্যবস্থা নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলোকে সংরক্ষণ করে। এ ছাড়া আদালতকে এই মতবাদে দেশের সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা ও অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতিঃ আধুনিক উদারনীতিবাদে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি পরিগ্রহণের কথা বলা হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে গতিশীল কর-ব্যবস্থা, শিল্প-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়করণ প্রভৃতি বিষয়গুলি জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভূক্ত।

বহুদলীয় ব্যবস্থাঃ আধুনিক উদারনীতিবাদের প্রবক্তরা বহুদলীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের পক্ষে আদর্শ বরে মনে করেন। তাঁদের মতে, জনগণের বহুমুখী আশা-আকাঙ্খার রূপায়ণ বহুদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতিঃ উদারনীতিবাদী দার্শনিকরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। তাঁদের মতে, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার না থাকলে তারা কাজ কর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এর ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বঃ উদারনীতিবাদে  সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে উদারনৈতিক গণতন্ত্র সংখ্যালঘুরা যথাযথ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ লাভ করেন।

ফ্যাসিবাদ বিরোধিতাঃ এই মতবাদে ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের একদলীয় একনায়কের শাসন, ব্যক্তিপূজা, অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ, জাতিবিদ্বেষ, আগ্রাসী সমরনীতি প্রভৃতি বিষয়গুলির কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠাঃ উদারনীতিবাদের মূলনীতি হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।

Leave a Comment